দাওয়াত ও তাবলীগ

তাবলিগ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রচার করা, প্রসার করা, দাওয়াত দেওয়া, বয়ান করা, প্রচেষ্টা করা বা পৌঁছানো প্রভৃতি। একজনের অর্জিত জ্ঞান বা শিক্ষা নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছানো এবং নিজে যতটুকু জানি অপরকে শিক্ষা দেওয়াকে তাবলীগ বলা হয়। তাবলীগের মুখ্য উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সঙ্গে নিজের এবং মানুষের পরিচয় ও সম্পর্ক হয়।আর আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যেমে সব সমস্যার সমাধান লাভ করে ইহকাল ও পরকালে শান্তি সফলতা লাভ করে।


দাওয়াত ও তাবলীগ সম্পর্কে কিছু প্রামান্য দলিল:




পৃথিবী শুরু থেকে যত নবী ও রসূল পৃথিবীতে আসছেন প্রত্যেক নবী ও রসূল এর মূল দায়িত্ব ছিল কালেমার দাওয়াত দেওয়া,এক আল্লাহর সাথেই মানুষকে পরিচয় করানো। নবুয়তের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আম্বিয়া কেরাম (আ.) বা নবীরা যে কাজ করতেন সে কাজের দায়িত্ব পরে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ওপর এসে পড়ে। মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর মাধ্যমে দুনিয়ায় দাওয়াতের কাজ শুরু হয়। আল্লাহর একত্ববাদ প্রচারের জন্য অসংখ্য নবী ও রাসুল প্রেরণ করা হয়েছে,তিনারা এ কাজ করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। দুনিয়ায় আল্লাহ পাক হুজুর( সা:) কে নবুয়াত দিয়ে পাঠিয়েছেন আর হুজুর(সা:) একশত ভাগ সাহাবা কেরাম(রা:) এর নিকট পৌঁছে দিয়েছেন। হুজুর পাক (সা:)বিদায় নিয়েছেন আর কোনো নবী-রাসুল দুনিয়াতে আসবেন না, তাই তাবলীগের আমলের দায়িত্ব ইসলামের সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতদের।


দশম হিজরিতে আরাফাতের ময়দানে বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, ‘আমিই সর্বশেষ নবী, বিধায় নবুওয়াত ও রিসালাতের অব্যাহত ধারার এখানেই পরিসমাপ্তি।

 অনাগত কালের মানুষের জন্য আল কোরআন ও সুন্নাহ রেখে গেলাম। এগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তোমাদের।’ সাহাবিরা এ অনুপ্রাণিত বক্তব্য শোনার পরপরই তাবলীগ করার জন্য তথা দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য সারা পৃথিবীতে সফর করেন। অনেক সাহাবা (রা:)আছেন জিনার আর বাড়ি ফিরে যাননি তিনাদের কবর আজ পৃথিবীর আনাচে কানাচে। এভাবে অনেক সাহাবায়ে কিরাম, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, ওলি-আউলিয়া, সুফি-দরবেশ ও হাক্কানি আলেম সমাজের কঠোর ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বিসর্জনের জন্য বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচার ও প্রসার লাভ করে।

প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর একটি বাক্য যদি আমাদের কারো জানা থাকে, তা অন্যদের পৌছে দিতে। রাসুল (সা.)-এর এই নির্দেশ পালন করা সব মুসলমানের জন্য জরুরী। দাওয়াত ও তাবলীগ এর জন্য মুসলমানদের এক জামাত বিশ্বব্যপি এ কাজটিই করছে।

আল্লাহ তাআ’লা ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি; মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের নির্বাচন করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১১০)


আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘আমি চাই তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক হোক যারা মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান করবে, ভালো কাজের আহ্বান করবে, আর মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। ওই দলটাই হলো সাফল্য লাভকারী।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১০৪)


‘আল্লাহর রাস্তায় একটা সকাল বা একটা বিকাল ব্যয় করা সারা দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম।’ ‘হে মুমিনগণ, তোমাদিগকে কি এমন একটি ব্যবসার সন্ধান দান করব যা তোমাদেরকে কঠোর আজাব থেকে রক্ষা করবে? তা হলো- তোমরা আল্লাহর ওপর ও আল্লাহর রাসূলের ওপর ঈমান আনবে, মেহনত করবে আল্লাহর রাস্তায় মাল ও জান দিয়ে।’ (সূরা আস-সাফ, আয়াত-১০)।


আল্লাহর রাস্তায় নিজে বের হওয়া এবং অন্য কেতৈরি করা এটা আমার দায়িত্ব মনে করা।


এটা নতুন কিছু না:-


দাওয়াতের মেহনত কোনো নতুন কিছু নয়। এই মেহনত আল্লাহর প্রিয় বান্দা নবী-রাসুল থেকে শুরু করে সাহাবায়ে কেরাম (রা:) করে গেছেন। অপর ভাইয়ের কাছে দিনের দাওয়াত পৌঁছতে হবে হেকমত ও ধৈর্যের সঙ্গে। অপর ভাইয়ের কাছে দাওয়াত পৌঁছানোর আগে তার অবস্থা জানতে হবে। তাকে বুঝিয়ে দিনের পথে আনতে হবে।

তাই দাওয়াতে তাবলীগের মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করা ও অন্যকে দাওয়াত দেয়া। এই আমলের দ্বারাই দীলে একিন দুরস্ত হয়ে আমলও ঠিক হয়ে যায়। মুরুব্বীরা বলেন-

√নেক আমল করে অথচ মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেয় না-তার ঈমান পূর্ন হলো না। দ্বীনের দাওয়াতের মাধ্যমেই আল্লাহ তায়ালার সাথে বান্দার সম্পর্ক পয়দা করা।

√এই মেহনত কারো তৈরি করা না। রাসুল (স.) ও তাঁর সাহাবীদের জীবন থেকে এই কাজের তরিকা নিতে হবে।

আল্লাহর পাকের সবচেয়ে বড় গজবের স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াতি কাজ হেঁটে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেয়া। কারণ হেঁটে বেশি মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া সম্ভব। এতে পায়ে যে ধূলাবালি লাগবে তা জাহান্নামের আগুনকে ঠাণ্ডা করে দেয়।


 কাদের জন্য এ কাজ?


কোনো দেশ, কোনো অঞ্চল বা কোনো গোষ্ঠীবিশেষের জন্য ইসলাম ধর্ম প্রেরিত হয়নি। সমগ্র বিশ্বের সব যুগের সব মানুষের জন্য ইসলাম ধর্ম । তাই দুনিয়াবাসীর জন্য ইসলামই হলো একমাত্র অনুসরণীয় ও অনুকরণীও আল্লাহর মনোনীত ধর্ম। পথভ্রষ্ট মানবজাতিকে পথের দিশা দিতে যুগে যুগে আল্লাহর মনোনীত ১ লাখ মতান্তরে ২ লাখ ২৪ হাজার নবী ও রাসূল দুনিয়াতে আসছেন এবং দাওয়াত ও তাবলিগের দায়িত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করে গেছেন। হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে সর্বশেষ আমার নবী ও রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)এর আগমন ও ওফাতের মাধ্যমে এ ধারার সমাপ্তি ঘটে।


হুজুরে পাক (সা.) এর পর থেকে এ দায়িত্ব খোলাফায়ে রাশেদিন, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন, তাবে-তাবেইন, সলফে সালেহিন এবং আলেমরা পালন করছেন।


 ১৯৪১ সালে দিল্লির মেওয়াতে মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) তাদেরই পদাঙ্কা অনুসরণ করে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ শুরু করেন। এর সম্প্রসারিত রূপ আজকের দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনত। মানুষের মুক্তি ও কামিয়াবি হাসিলের উদ্দেশ্যে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং আমলে সালেহ (সৎ কাজ বা ভালো কাজ) করাই এ দাওয়াতের মুখ্য বিষয়।


দ্বীনি দাওয়াতের অর্থ হলো দ্বীনের পথে মানুষকে আহ্বান করা। বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থা এমন পর্যায়, হারামকে হালাল মনে করা হচ্ছে ,বিজাতীয় সংস্কৃতি আমাদের গিলে ফেলেছে ,মনে হয় এটাই টিক এ প্রেক্ষাপটে দাওয়াত ও তাবলীগের কোনো বিকল্প নেই।এক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান হলো সবাইকে এই দ্বীনি দাওয়াতের কাজে এগিয়ে আসা। এবং এ দাওয়াতি কাজটি আমার মনে করে ব্যক্তিগতভাবে, সমষ্টিগতভাবে করা।

আর এ কাজের দ্বারা মানুষ পথের সন্ধান পাবে ,বিপথগামী মানুষ সঠিক পথ পাবে, চরিত্রবান ও সৎ মানুষ তৈরি হবে, অভাবগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত, দুস্থ, এতিম, অসহায়ের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার মানুষ তৈরি হবে, 

মহৎ কর্মের উপমা সৃষ্টি করা, ভালো কাজে উৎসাহী করা, মন্দ থেকে বিরত রাখা, কর্মচঞ্চল করা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া, এক কথায় ইহকাল ও পরকালের শান্তির জন্য মানুষকে সত্য ও সরল পথে চলার আহ্বানই হচ্ছে দাওয়াত বা তাবলীগ।


দাওয়াত ও তাবলীগে সময়, জান ও মাল উৎসর্গ করে আল্লাহর পথে বের হয়ে আল্লাহ এবং রাসূল (সা:)প্রকৃত প্রেমিক হতে হবে। তবেই মানুষ আহ্বানে সাড়া দেবে। নিজের আত্মিক উন্নতি ও দ্বীন শিক্ষার জন্য বাইরে না গেলে কোন ব্যক্তির রুহানী পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই দ্বীন শিখতে হলে ঘর ছাড়তে হবে। 


সকল নবী রাসূলেরা এই কাজ করে গেছেন। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) নবুওয়াতের পূর্বে দীর্ঘদিন যাবত হিরা গুহায় মেহনত করেছিলেন কিভাবে জাতিকে তাওহিদমুখী করা যায়। তার পর আল্লাহ তাকে নব্যুওয়াতের মত মর্যাদাকর সার্টিফিকেট প্রদান করেন। সুতরাং মেহনত ছাড়া এই পৃথিবীতে কোন কিছুই সম্ভব নয়।


তাই আসুন, রসূল (সা:)এর এতিম দিনকে আমর আমিত্ব ও স্বার্থের বন্ধন ছিন্ন করে দুনিয়ার মাঝে একসাথে ছড়িয়ে দিই।

আল্লাহ e অধমকে কবুল করুন।

আরও পড়ুন


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.