গরুর ফুড পয়জনিং সম্পর্কে আলোচনা।


গরুর ফুড পয়জনিং রোগ ও চিকিৎসা। ফুড পয়জনিং

গবাদিপশুর ফুড পয়জনিং রোগটি গবাদিপশুর একটি মারাত্মক সমস্যা। সকল ঋতুতেই গরুর ফুড পয়জনিং সমস্যা হতে পারে।গবাদিপশুর খাবার ও খাদ্যাভাস জনিত কোনো ত্রুটি হলে গরুর ফুড পয়জনিং হতে দেখা যায়।সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না করলে প্রাণির মৃত্যু ঝুঁকি থাকে।পশুপালন ব্যবসায় খাদ্যে সর্বাধিক ব্যয়ের কারণে সুষম খাদ্যের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ঘাস পশুখাদ্যে বেশ খানিকটা পুষ্টির যোগান দেয়। কারণে এগুলোকে দানাদার খাবারকে সর্বোত্তম পশুখাদ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনেক কারণে খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটতে পারে, যা পশু মালিকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না, তবে কিছু বিষক্রিয়া যা পশুপালকদের জ্ঞানের অভাবে ঘটে থাকে।খামারিরা যদি কিছু বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেন তাহলে গবাদিপশুর ফুড পয়জনিং হতে কিছুটা হলেও নিস্তার পাওয়া যায়।ফুড পয়জনিং সাধারনত যে কারণে হয় তার আলোচনা করার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ।

  • সায়ানাইড বিষক্রিয়ায়।
  • নাইট্রেট বিষক্রিয়া।
  •  ইউরিয়া বিষক্রিয়া।

সায়ানাইড বিষক্রিয়াঃ

উদ্ভিদে সায়ানোজেনিক গ্লুকোসাইড থাকে। এই গ্লুকোসাইডগুলির মধ্যে রুমেনে উপস্থিত এনজাইম থাকে। সায়ানাইড বিষক্রিয়ায়, অক্সিজেন বহনকারী এনজাইমগুলি প্রভাবিত হয়, যার ফলে শরীরের টিস্যুতে অক্সিজেনের অভাব হয় এবং শ্বাসরোধে প্রাণীর মৃত্যু হয়। যদিও অনেক গাছপালা/খাদ্য আছে যাদের সেবনে সায়ানাইডের বিষক্রিয়া হতে পারে, কিন্তু এগুলোর সায়ানাইডের পরিমাণ বিভিন্ন ঋতুতে এবং গাছের বিভিন্ন অংশে পরিবর্তিত হয়। 

পশুখাদ্যে বিষের পরিমাণ ও তার অবস্থা, মাটিতে নাইট্রোজেনের উপস্থিতির হার,

পশুখাদ্যের বৃদ্ধির জন্য দেওয়া ইউরিয়া বা অন্যান্য সারের পরিমাণ,পানির অভাব ইত্যাদি কারণের উপর নির্ভর করে। বিশেষ করে যেসব গাছের বৃদ্ধি ও বিকাশ পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যায়, পাতা শুকিয়ে হলুদ হয়ে যায়, এই ধরনের খাদ্যে সায়ানাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়। অনেক সময় পশু এগুলি খেয়ে ফেলে এবং এর ফলে বিষক্রিয়া দেখা দেয়।

সায়ানাইড বিষক্রিয়ার লক্ষণঃ সায়ানাইডযুক্ত খাবার আকস্মিক মাত্রাতিরিক্ত হলে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রাণীতে বিষক্রিয়ার লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে।যেমন -

  • প্রণীটি অস্থির হয়ে ওঠে,
  •  তার মুখ থেকে লালা বের হয়।
  • শ্বাস নিতে অসুবিধা হয় এবং
  • মুখ খুলে শ্বাস নেয়।
  • পেশীতে খিঁচুনি ও ব্যথা হয়,
  •  প্রচন্ড দুর্বলতার কারণে প্রাণীটি মাটিতে পড়ে যায় ।
  • হাইড্রোসায়ানিক এসিড তৈরি হয় যা বিষাক্ত হয়ে পড়ে।
  • মুখে পঁচা বাদামের মতো গন্ধ এবং
  •  রক্তের রং উজ্জ্বল লাল হয়ে যায়।
  • মৃত্যুর সময় শ্বাসরোধের মতো হাহাকার এবং ব্যথা থাকে।

সায়ানাইড বিষক্রিয়ার চিকিৎসাঃ

সায়ানাইড বিষাক্ততার লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর শিরাপথে ২০০ মিলিলিটার পানিতে ৩ গ্রাম সোডিয়াম নাইট্রাইট এবং ১৫ গ্রাম সোডিয়াম থায়োসালফেট দিন।তার আগে পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

সায়ানাইড বিষক্রিয়ার কারণঃ

পশুখাদ্যে বিষের পরিমাণ, তার অবস্থা, মাটিতে নাইট্রোজেনের উপস্থিতি,

পশুখাদ্যের বৃদ্ধির জন্য জমিতে দেওয়া ইউরিয়া বা অন্যান্য সারের পরিমাণ পানির অভাব ইত্যাদি কারণের উপর নির্ভর করে।

সায়ানাইড বিষক্রিয়ার প্রতিকারঃ

  • বিশেষ করে যেসব গাছের বৃদ্ধি ও বিকাশ পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যায়, পাতা শুকিয়ে হলুদ হয়ে যায়, সেসব গাছে সায়ানাইডের পরিমাণ বেড়ে যায় তাই এ জাতীয় খাবার খাওয়ানো থেকে বিরত থাকা।
  • শুধুমাত্র ভালোভাবে সেচ দেওয়া জোয়ার ও চারি পশুকে সবুজ চারা হিসেবে দিন। দুই থেকে চারটি বৃষ্টির পর দাঁড়িয়ে থাকা ফসল পশুদের খাওয়ান। সায়ানাইড আক্রান্ত ফিডকে 'হে' হিসাবে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
  • সায়ানাইড আক্রান্ত জোয়ার ও চারি সবুজ চারা কিছুক্ষণ শুকানোর পর তাতে গুড় মিশিয়ে সাইলেজ আকারে খাওয়ালেও বিষের প্রভাব কমে যায়। ছোট শুকনো, হলুদ এবং শুকনো গাছকে পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করবেন না।

নাইট্রেট বিষক্রিয়াঃ

নাইট্রেট বিষাক্ততা উচ্চ নাইট্রেটযুক্ত ফিড বা পানি খাওয়ার ফলে হতে পারে। তবে পশুখাদ্যে নাইট্রেটের পরিমাণ সাধারণত বেশি থাকে না, কিন্তু যখন জমিতে নাইট্রোজেনযুক্ত সার অতিরিক্ত পরিমাণে দেওয়া হয়, তখন সেই জমিতে জন্মানো সবুজ চারায়, বিশেষ করে ভুট্টা, ওটস, সুদান ঘাস ইত্যাদিতে নাইট্রেটের পরিমাণ বেড়ে যায়।উচ্চ নাইট্রেটযুক্ত খাদ্য/পানির আকস্মিক মাত্রাতিরিক্ত মাত্রার ফলে নাইট্রেটগুলি নাইট্রাইটে রূপান্তরিত হয়, যা অত্যন্ত বিষাক্ত। হিমোগ্লোবিনকে মেট হিমোগ্লোবিনে রূপান্তরিত করে, যার কারণে অক্সিজেন শরীরের টিস্যুতে পৌঁছায় না। ০.১৫ শতাংশ পর্যন্ত নাইট্রোজেন শুষ্ক ভিত্তিতে ক্ষতিকর নয়, যেখানে ০.৪৫ শতাংশের উপরে পরিমাণ অত্যন্ত বিষাক্ত।

নাইট্রেট বিষক্রিয়া লক্ষণ সমুহঃ 

অনান্য বিষক্রিয়ার মত এই রোগেও কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে। সাধারণত খাওয়ার মাত্রার উপর এই লক্ষণের কম বেশি দেখা যায়-

  • শ্বাস কষ্ট এবং বার বার হাপিয়ে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা।
  • খুব দ্রুত শ্বাস প্রাশ্বাস নেয়াও।
  • লালা ঝরে।
  • পাতলা পায়খানা।
  • নীল রঙের মিউকাস মেমব্রেন দেখা যায়।
  • প্রসাবের কোন রঙ থাকেনা।
  • নাইট্রেট রক্ত নালীর প্রসারতা বাড়িয়ে রক্তের চাপ কমিয়ে দেয়
  • খাওয়া বন্ধ করে দেয়, খোড়াতে থাকে এবং মাত্রা বেশি হলে ২- ২৪ ঘন্ঠার মধ্যে মারা যেতে পারে।
  • প্রাণীটি পেটের দিকে মাথা ঘুরিয়ে মুখ খোলা রাখে।
  • বিষক্রিয়ার তীব্র পর্যায়ে রক্তের রং চকোলেট বাদামী হয়ে যায় এবং প্রাণীটি ১ থেকে ৪ ঘন্টার মধ্যে মারা যায়।

নাইট্রেট বিষক্রিয়া কারণঃ

  • নাইট্রেটের পরিমান যদি অতিরিক্ত পরিমানে অথবা খুব ঘন ঘন বেশি পরিমান যদি প্রাণির পেটে যায়।
  • নাইট্রেটের পরিমান এবং রুমেনে উপস্থিত মাইক্রোফ্লোরার(উপকারী অণুজীব) উপস্থিতির উপর রোগের মাত্রা নির্ভর করে।
  • রুমেন মাইক্রোফ্লোরা এই নাইট্রেট কে নাইট্রাইট এবং পরে রিডাকটেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে নাইট্রাইটকে আমোনিয়া ও প্রোটিনে পরিনত করে। কিন্তু যদি রক্তে তা অতিরিক্ত পরিমান উপস্থিত থাকে তাহলে বিষক্রিয়া প্রদর্শিত হয়।
  • শুধু মাত্রার উপরই নয় প্রাণির দেহের অবস্থার উপর ও এর মাত্রা নির্ভর করে। ৪.অনেক সময় বেশি পরিমানে একবারে খায়,
  • অল্প অল্প করে অনেক বারে খায় তাহলে এর বিষক্রিয়া অনেক বেশি হয়ে যায়।
  • খালি পেটে অল্প পরিমান খেলেও অনেক সময় বিষক্রিয়া প্রদর্শিত হয়।

নাইট্রেট বিষক্রিয়া চিকিৎসাঃ 

নাইট্রেট বিষক্রিয়া দেখা দিলে রক্তে মিথোহিমোগ্লবিন এর পরিমান কমিয়ে দেয়া এর মূল উদ্দেশ্য। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল কাজ করে মিথাইলিন ব্লু ১% সল্যুশন করে ৮.৮ মিলিগ্রাম হিসেবে আস্তে আস্তে শিরা পথে প্রয়োগ করা।মিথসিলিন ব্লু ২০-৩০ মিনিট পর পর দিতে হবে,কারন এর কার্যকারিতা ২ ঘন্ঠা স্থায়ি থাকে। তাই ২ ঘন্ঠা পরে প্রয়োজনে আবার দেয়া যায়।অতিরিক্ত চিকিৎসা হিসেবে অতিরিক্ত অক্সিজেন সরবরাহ, এন্টিবায়োটিক দেয়া যাবে।প্রয়োজনে রক্ত দিতে হবে।

নাইট্রেট বিষক্রিয়া প্রতিরোধঃ

সব সময়ই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। তাই প্রাণির সংস্পর্শ থেকে এসব নাইট্রেটের উৎস সরাতে হবে।জমিতে বেশি সার বা বিষ প্রয়োগের পরিবর্তে বিকল্প স্বাভাবিক ব্যবস্থা করতে হবে।জমিতে রাসায়নিক স্যারের পরিবর্তে জৈব সার বেশি ব্যাবহার করা।গরুকে মাঠের মধ্যে ছেড়ে চড়ানোর ব্যপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে,ডুবে যাওয়া জমির ঘাস বেশি না খাওয়ায় ভাল।

ইউরিয়া বিষক্রিয়াঃ

গরু মোটাতাজা করেনে ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র ( UMS ) একটি সুলভে অত্যাবশ্যকীয় গোখাদ্য।কিন্তু এর একটি খারাপ দিক আছে।UMS গরুর খাবার পর অনেক সময় বিষক্রিয়া দেখা যায় যা ইউরিয়াজনিত বিষক্রিয়া বলে ধরা হয়,যদি বিষক্রিয়া হয় তাহলে কি করণীয় সে সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই জানা নেই,যা আমাদের জানা দরকার।এক কথায় বলা যায় ইউরিয়া মেশানো খাবার খাওয়ানোর পর কোন কোন গরুর দেহে বিষক্রিয়া সৃস্টি হতে পারে। বিষক্রিয়া সৃস্টি হলে তার লক্ষণ ,কারন,ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করব ইনাআল্লাহ।

ইউরিয়া বিষক্রিয়া লক্ষন সমুহঃ-

  • ইউরিয়া বিষক্রিয়ার গরুর মুখ দিয়ে অতিরিক্ত লালা ঝড়বে।
  • গরু ঘন ঘন প্রস্রাব ও পায়খানা করবে।
  • গরুর পেট গ্যাসের কারনে তুলামুল অত্যধিক ফুলে যাবে।
  • গরু শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কস্ট হবে।
  • গরুর শরীরের বিভিন্ন অংশের মাংস কাপতে থাকবে।
  •  সামনের পা দুটি দ্বারা খোঁড়াতে থাকবে।
  • বিষক্রিয়া বেশি হলে খিচুনি শুরু হবে।
  •  ২-৩ ঘন্টার মধ্যে গরু মারা যেতে পারে।

ইউরিয়া বিষক্রিয়ার প্রতিকার ও সাবধানতাঃ 

  • গরুর ইউরিয়াজনিত বিষক্রিয়ায় গরুকে বসতে বা শুতে দেয়া যাবেনা।
  • পানি বা অন্য যে কোন প্রকার খাবার খেতে দেয়া যাবেনা।
  • গরুর শরীরে প্রচুর পরিমান ঠান্ডা পানি ঢালতে হবে।
  • গরুর পেট বেশি ফুলে গেলে পায়খানার রাস্তায় হাত ঢুকিয়ে যতটুকু সম্ভব গোবর বের করে দিতে হবে।
  • গরুর খিচুনি শুরু হওয়ার আগেই পেটের গ্যাস বের করতে হবে। এক খন্ড শক্ত ডাল আড়াআড়ি ভাবে গরুর মুখের ভেতরে বেধে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে অতি সহজেই পেটের গ্যাস সহজে দ্রুতো বের হয়ে যেতে পারে। অথবা নিডেল ফুটিয়ে গ্যাস বের করার ব্যবস্থা করতে হবে।
  •  বিষক্রিয়া হলে গরুকে পাকা তেতুল পানিতে গুলিয়ে খাওয়াতে হবে।
  • ৩ ঘন্টার মধ্যে বিষক্রিয়া না কমলে গরুকে আবার পাকা তেতুল পানিতে গুলিয়ে খাওয়াতে হবে।
  • পশু চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে বয়স্ক গরুর মাংসপেশীতে ইনজেকশন দেয়া যেতে পারে।

আরও পড়ুন -























Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.