কবুতর পালতে গিয়ে কমন যেসব রোগের মুখোমুখি হন সেগুলো সম্পর্কে আমার স্বল্প জানা এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করার চেষ্টা করছি। আলোচনাটি মুলত নতুন কবুতরের কমন রোগ এবং রোগের লক্ষন ও প্রতিরোধের উপায়গগুলো সম্পর্কে ধারনা দেবার জন্য। প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান না থাকার কারণে প্রতিকারের দিকটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবো,তবে যেটুকু পারি আলোচনা করবো।তবে ভালো হয় প্রতিকারের জন্য আমার মতে জিনার ভেট প্রফেশনাল অথবা অভিজ্ঞ তাদের ওপর নির্ভর করাই যুক্তিযুক্ত হবে।
তবে সেকেন্ডারী ইনফেকশন থেকে রক্ষা করার জন্য ভেটেরিনারী ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে এন্টিবাইওটিক দেয়া যেতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বল্প মাত্রায় ক্যালশিয়াম, ভিটামিন বি এবং মাল্টিভিটামিন সাপ্লিমেন্ট উপকারী হতে পারে, তবে তা অবশ্যই ভেট ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে দেয়া উচিত।
রানীক্ষেত রোগঃ
রানীক্ষেত কবুতরের ভাইরাস জনিত তীব্র ছোঁয়াচে রোগ, একবার আক্রন্ত হলে সহজে কবুতর বাঁচানো সম্ভব হয় না। ভাইরাস হবার কারনে এর কোন চিকিৎসা নেই।মৃত্যুর হার ৯৮%। কপাল ভাল হলে খুব কমই কবুতরকে বাঁচানো সম্ভব হয়।
রোগের লক্ষণঃ
১. প্রথমদিকে আক্রামত্ম পাখি দলছাড়া হয়ে ঝিমাতে থাকে।
২. শরীরে কাপুনি হয় এবং ঘন ঘন শ্বাস গ্রহন করে।
৩. সাদাটে সবুজ পাতলা পায়খানা করে ও দুর্বল হয়ে পড়ে।
৪. মুখ হা করে থাকে, কাশতে থাকে, নাক মুখ দিয়ে শেস্নষ্মা ঝরে।
৫ শরীর শুকিয়ে যায়,মাথার ঝুটি ও গলার ফুল কালচে হয় এবং চোখ মুখ ফুলে যায়।
৬.খাবারের প্রতি অনিহা, নড়াচড়ায় অনিহা।
৭.প্রচুর মুত্র সম্বলিত মল, তা সবুজ হলেও ভিন্ন রংও হতে। পারে বেশীরভাগ সময় প্রাথমিক পর্যায়ে পরিস্কার মুত্রের মাঝে সরু ভাঙ্গা ভাঙ্গা কঠিন মল দেখা যায়।
৮.বমি করে অথবা মাথা ঝাকিয়ে বমি করার চেষ্টা করা।
প্রতিরোধ:
১.ভ্যাক্সিন এবং
২.বাইওসিকিউরিটি এই দুইয়ের সমন্বয় ছাড়া এই রোগ প্রতিরোধের দ্বিতীয় কোন পথ নেই।
ক্যাংকার:
কবুতরের খুব কমন একটি রোগ যা বয়ষ্ক কবুতরের ক্ষেত্রে খাবার পানি, আক্রান্ত কবুতরের মুখ থেকে পরা খাবার এবং বাচ্চাদের ক্ষেত্রে খাওয়াবার সময় বাবা-মা থেকে বাচ্চাদের ভেতর সংক্রামিত হয়। ক্যাংকার নডুল কবুতরের মুখ, গলা, ক্রপ সহ পরিপাক তন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট অঙ্গে এ রোগের লক্ষণ দেখে দিতে পারে। এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাচ্চাদের নাভীতে অথবা কবুতরের সাইনাসেও দেখা যেতে যায়। মনে রাখতে হবে চিকিৎসায় অবহেলা হলে কবুতর মারা যায়।
লক্ষন:
শরীরের কোথায় ক্যাংকার সংক্রমন হয়েছে তার ঊপর নির্ভর করে রোগের লক্ষন বিভিন্ন রকম হতে পারে।
১.মুখের ভিতরে হাল্কা হলদে রঙের ঘা দেখা যায়।
২খাবার বার বার ঠোঁটে নেয় কিন্তু গিলতে পারেনা যা অন্যতম একটি চিহ্ন হতে পারে।
৩.বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে থ্রোটে সংগক্রমনের ফলে টনসিলে ঘা দেখা যায়
৪.শ্বাস কষ্ট একটি কমন লক্ষন।
৫.ওড়ার পর বার বার ঢোক গিলার মতো করা।
৬.খাবারে প্রতি কোনো আগ্রহ থাকে না।
হজমে সমস্যা
৭.ওজন হ্রাস পেতে থাকে।
৮.কিছু খেলে বা খাওলে হজমে সমস্যা দেখা যায়।
৯.ডাইরিয়া দেখা দিতে পারে।
৯.কবুতরকে অবশাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে।
১০.কবুতর উড়তে অনিচ্ছুক হয়।
১১.রোগের এক পর্যায়ে মুখের মধ্যে থেকে গন্ধ বের হয়।
প্রতিরোধ:
১.কবুতরের লফটের ভিতর পরিষ্কার এবং শুষ্ক রাখুন।
২.পরিষ্কার পানি এবং ফাঙ্গাস মুক্ত খাদ্য দিন।
৩.মাঝে মাঝে জীবাণুমুক্ত স্প্রে করুন।
৪.নিয়মিত ভিটামিন সি ও লাল চা ক্যাঙ্কার প্রতিরোধে ভাল ভুমিকা
৫.খাবার এবং পানির ক্ষেত্রে বায়োসিকিউরিটি মেনে চলা।
৬. নতুন কবুতর সংযোজনের ক্ষেত্রে আলদা জায়গায় রাখুন ১৪ দিন। ৭.কবুতরের লফটে ভাইরাস বহন করে এমন সব কিছুর আনাগোনা নুন্যতম পর্যায়ে রাখা।
৮.নিয়মিত ক্যাংকার প্রতিরোধী ড্রাগ বা প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা। এক্ষেত্রে লফটে ক্যাংকারের উপদ্রবের মাত্রা অনুযায়ী ভেটেরিনারী বিশেষজ্ঞ দের মতামত নিয়ে মাসিক এন্টি ফাংগাল এবং মেট্রোনিডাযোল অথবা রোনিডাযোল গ্রুপের ড্রাগ ব্যবহার করা যেতে পারে।
৯.অনেক লফটের বাচ্চা হবার পর মুখে ঘায়ের সমস্যা দেখা যায়।এজন্য বাচ্চা ফুটার পর ৩ দিন মেট্রোনিডাযোল ঔষধ দেয়া হলে ইনশা আল্লাহ এই সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা যাবে।
মেট্রোনিডাযোল গ্রুপের মানুষের অথবা ভেট যেকোনোটি দিতে পারেন।
মানুষের ঔষধগুলোর ভেতর ফ্লাজিল, এমোডিস, ফিল্মেট ইত্যাদি ।
ভেট ঔষধের ভেতর ডাইরোভেট বোলাস, ডাইরোভেট WSP, এমোডিস বোলাস ইত্যাদি পাওয়া যায়।
তবে খাইবার আগে অবশ্যই ভেট ডাক্তার বা পশু হসপিটালে যোগাযোগ করবেন।
চিকিৎসা:
১.ক্ষত জায়গা পরিষ্কার করে তার উপর MYCON ORAL GEL দিনে 2/3 বার লাগাতে হবে।
২.Riboflabin(রিবোফ্লাবিন )ট্যাবলেট 2 টা দিনে ২ বার গুড়া করে খাওয়াতে পারেন।
৩.যদি কবুতর না খেতে পারে লিকুইড জাতীয় কিছু খাইয়ে দিতে হবে।
পিজন পক্স:
এমন কোন কবুতর পালনকারী খুজে পাওয়া মুশকিল যে এই পিজন পক্স এর উপদ্রব মুক্ত আছেন। বাচ্চা কবুতরের ভেতর সব থেকে বেশী দেখা যায়। পিজন পক্স দু ধরনের দেখা যায় যা খুব সম্ভবত দুটি ভিন্ন পথে সংক্রমন ঘটে।
১.মশার কামড় থেকে এবং
২.ড্রপলেট সংক্রমন
সাধারণত মশার কামড় থেকে ভাইরাস কবুতরের দেহে প্রবেশ করে এবং দেহের যে স্তনে পশম নাই ওই স্থানগুলোতে যেমন ঠোট, চোখের চার পাশ, পা, পায়ু পথের চারপাশ ইত্যাদি স্থানে মশার কামড়ের স্থানে হলদে গোটা তৈরি হতে দেখা যায়। তবে ৩/৪ সপ্তাহের ভেতর গোটাগুলো আপনা থেকেই শুকিয়ে পড়ে যায়।
দ্বিতীয় ধরনের সংক্রমন খুব সম্ভবত ড্রপলেট সংক্রমন যা শ্বসন-তন্ত্র দ্বারা সংক্রমিত হয়ে এটা সাধারনত মুখের মিউকাস মেমব্রেনগুলোতে ঘা বা ক্ষত সৃষ্টি করে। এই ধরনের সংক্রমন খুবই মারত্মক আকার ধারণ করে।
১.যে কবুতরকে আক্রান্ত হয় সুস্থতা লাভ করলেও ঠোট বাঁকা হয়েযেতে দেখা যায়। ২.অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত কবুতর খাওয়া বন্ধ করে দেয়।
৩.খুবই দ্রুত ওজন হ্রাস পায়,
৪. শ্বাস নিতে কষ্ট হতে হয়।এবং
৫.আস্তে আস্তে মৃত্যু মুখে ঢলে পড়ে।
যেহেতু এটা ভাইরাস গঠিত রোগ তাই অন্য যেকোন ভাইরাস রোগের মতোই এর কোন ঔষধ নেই। তবে কিছু পদক্ষেপ মাধ্যেমে অল্প সময়ে এই পক্সের গোটা শুকাতে পারা যায়।
যেমন ইন্সুলিন নেবার সিরিঞ্জের সুচ দিয়ে গোটার ওপরের আবরন দু তিন স্থানে ফুটা করে দেয়ার পর ব্যাক্ট্রোসিন অয়েনমেন্ট লাগিয়ে দিলে দ্রুত গোটা শুকিয়ে যায়।
সাবধান , সুচ বেশী ভেতরে ঢুকান যাবে না, শুধু মাত্র ওপরের আবরনটুকু ফুটো করে দিতে হবে।
প্রতিরোধ:
১.এ রোগের কোনো ভ্যাকসিন আমাদের দেশে আছে কি না জানা নাই,যদি থাকে তাহলে ভ্যাকসিন করানো।
২.মশার কামড় থেকে কবুতরকে বিশেষ করে বাচ্চা কবুতরকে রক্ষা করা।
৩.মশার উপদ্রব দেখেলে লফট বা খাচা চট বা মশারীর কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা।
কবুতরের কৃমি:
কবুতরের কৃমি বা কীট রোগ কবুতরের অবস্থার উপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কবুতরের পারামক্সি,সাল্মনিল্লা এর পর সবচেয়ে মারাত্মক যে রোগ সেটা হল Internal & External Parasites । আমরা ক্রিমির ব্যাপারে আলোচনা করবো
সাধারনত অস্ব্যাস্থকর পরিবেশ, ময়লা ধুলা - বালি যুক্ত খাবার এবং ছেড়ে পালা কবুতরের বিভিন্ন যায়গায় ঘুরে ঘুরে খাওয়া, আক্রান্ত কবুতরের পুরাতন মল এসব থেকে কবুতরের কৃমি সংক্রমন হয়ে থাকে। সাধারনত হেয়ার, রাউন্ড এবং টেপ কৃমি দেখা যায়।
লক্ষন:
১.পর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহনের পরেও স্ব্যাস্থের কোনো উন্নতি হয় না।
২. ওজন হ্রাস পায়।
৩.পাতলা ড্রপিং।
৪.বিভিন্ন রং এর পায়খানা করা।
৫. বমি করা।
৬. পায়খানায় দূর্গন্ধ দেখা দিতে পারে।
৭.পায়খানার সাথে কৃ্মি বের হওয়া অথবা কৃমির লার্ভা/ডিম বের হওয়া।
৮.খাবার হজম না হওয়া।
৯. কবুতর দিন দিন শুকিয়ে যাওয়া
১০.ডিম/বাচ্চা না দেওয়া অথবা কম দেওয়া।
প্রতিরোধঃ
১. কবুতরের ড্রোপিং বা মল নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
২.নিয়মিত ভালো জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে হবে।
৩.খাবার পানির পাত্র ও খাবার পাত্র প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে।
৪.রোগ আক্রান্ত কবুতরকে আলাদা করে রাখতে হবে।
৫.নিয়মিত খাঁচা বা খামার পরিষ্কার রাখতে হবে।
৬.২ থেকে ৩ মাস পর পর কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়াতে হবে।
৭.বাইওসিকিউরিটি ব্যবস্থা মেনে চলতে হবে।
চিকিৎসাঃ
১.Avinex পাউডার পানি এক লিটার সঙ্গে এক গ্রাম পাউডার।
২.Wormazole ছোট কবুতরের জন্য ছোট ১ ড্রপ।(খুব ছোট কবুতরের বাচ্চা কে ক্রিমির ওষুধ খাওয়ানো যাবে না)
৩. বড় কবুতরের জন্য এক ড্রপ।
৪.Asca Pilla ট্যাবলেট। কবুতরের জন্য ১(এক) টা ট্যাবলেট।
৩। Panacure: প্রতিটি কবুতরের জন্য ৪ ভাগের ১ ভাগ ট্যাবলেট।
৪। Avinex: পানি ১(এক) লিটার সঙ্গে ১(এক)গ্রাম পাউডার।
১. তিন মাস পরপর কৃমি কোর্স করানো।
-এসিমেক ১% : ১ মিলি/ লিটারে
– এভিনেক্স : ১ গ্রাম/লিটার
– নিম পাতার দ্রবন
২.ভেটেরিনারী ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ৭ বা ১৪ দিন পর পর একাধারে দুই তিন বার কৃমি কোর্স করালে দীর্ঘ মেয়াদী কৃমি মুক্ত রাখা সম্ভব হয়।
৩.ব্রীডিং সিজন এবং উড়ানোর সিজন শুরু হবার আগে কৃমি কোর্স করিয়ে নিলে সিজনের কার্যাবলীতে বাধা আসে না।
কৃমি কোর্সের আগে এবং পরে লিভার টনিক, ইলেক্ট্রোলাইট এবং পরবর্তীতেত প্রোবাইওটিক এবং মাল্টিভিটামিন ব্যবহার করা উচিত। কিছু কিছু গ্রুপের কৃমির ঔষধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা প্রায় অপরিহার্য
বিঃদ্রঃ কৃমিনাশকের সাথে ভিটামিন ও মিনারেল প্রিমিক্স এবং এমাইনো এসিড খাওয়াতে হবে।
আরও পড়ুন ----